অতীশ দীপংকর: বাংলার বৌদ্ধ দর্শনের দীপ্তিমান প্রদীপ
অতীশ দীপংকরের শৈশব ও শিক্ষা
অতীশ দীপংকরের প্রকৃত নাম ছিল চন্দ্রগর্ভ। তিনি এক উচ্চবংশীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন কৈবর্ত বংশীয় এবং মাতা ছিলেন শৈব। শৈশব থেকেই তিনি ধর্ম, দর্শন এবং বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে শুরু করেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন এবং পরে নালন্দা মহাবিহারে শিক্ষাগ্রহণ করেন।
নালন্দা থেকে শিক্ষা গ্রহণের পর তিনি বিখ্যাত বিক্রমশিলা মহাবিহারে যান, যা তৎকালীন ভারতের অন্যতম প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। সেখানে তিনি ধীমান্ত্র, বৌদ্ধ দর্শন, এবং বিভিন্ন শাস্ত্রের ওপর গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
অতীশ দীপংকরের তিব্বত গমন
অতীশ দীপংকরের জীবন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয় যখন তিব্বতের রাজা ল্যাং দার্মার আমন্ত্রণে তিনি তিব্বতে যান। তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম তখন অপমানিত এবং প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় ছিল। অতীশ দীপংকর সেখানে গিয়েই বৌদ্ধ ধর্মের পুনর্জাগরণ শুরু করেন। তাঁর লেখা "বোধিপথ প্রদীপ" (Bodhipathapradīpa) গ্রন্থটি তিব্বতে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এটি মূলত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসরণীয় পথ সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করে।
তিব্বতে অবদান
তিব্বতে অতীশ দীপংকর প্রায় ১৭ বছর অবস্থান করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন বিহার প্রতিষ্ঠা করেন এবং বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের নতুন করে প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর প্রচেষ্টায় তিব্বতে মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে। তিব্বতের জনগণ তাঁকে ‘জো-ওয়ো-জি’ বা গুরু হিসেবে সম্মান করত।
তাঁর নেতৃত্বে তিব্বতের বৌদ্ধ সমাজে শৃঙ্খলা ফিরে আসে এবং বিভিন্ন বিহারে ধর্মচর্চা ও শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হয়। অতীশ দীপংকরের মৃত্যুর পরেও তাঁর শিষ্যরা তাঁর শিক্ষাকে অনুসরণ করে তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যান।
অতীশ দীপংকরের দর্শন
অতীশ দীপংকর মূলত বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান শাখার অনুসারী ছিলেন। তাঁর দর্শনে করুণা, প্রজ্ঞা এবং শীল সংযমের গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি বিশ্বাস করতেন যে জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার সমন্বয়েই প্রকৃত মুক্তি সম্ভব। তাঁর লেখা "বোধিপথ প্রদীপ" গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন যে একজন সাধকের করণীয় কী এবং কিভাবে তিনি আত্মিক মুক্তি অর্জন করতে পারেন।
তিনি মানুষকে অহিংসা, দয়া এবং সত্যের পথে চলার উপদেশ দিতেন। তাঁর শিক্ষায় বৌদ্ধ ত্রিরত্ন—বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘের প্রতি গভীর ভক্তি এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শিত হয়েছে।
বাংলার বৌদ্ধ সমাজে অবদান
অতীশ দীপংকরের জীবন ও দর্শন বাংলার বৌদ্ধ সমাজে এক নবজাগরণ সৃষ্টি করে। যদিও তাঁর অধিকাংশ কর্মজীবন তিব্বতে কেটেছে, তবে তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ বাংলার মানুষকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বাংলার বিভিন্ন স্থানে তাঁর স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে, যা আজও তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
অতীশ দীপংকর সম্পর্কিত ঐতিহাসিক স্থান
১. বজ্রযোগিনী গ্রাম: এটি তাঁর জন্মস্থান এবং এখানে একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে যা অতীশ দীপংকরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। ২. নালন্দা মহাবিহার: এটি ছিল তাঁর শিক্ষা গ্রহণের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। ৩. তিব্বতের থোডিং মঠ: এখানে তিনি তাঁর শেষ দিনগুলি অতিবাহিত করেন এবং মৃত্যুবরণ করেন।
উপসংহার
অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান ছিলেন এক মহান পণ্ডিত, দার্শনিক এবং ধর্মগুরু। তাঁর জীবন ও কর্ম বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। তিব্বতে তাঁর অবদান এবং বাংলার বৌদ্ধ সমাজে তাঁর প্রভাব যুগ যুগ ধরে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। আজকের দিনে যখন আমরা ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই, তখন আমরা দেখতে পাই যে অতীশ দীপংকর ছিলেন সত্য, জ্ঞান এবং করুণার প্রতীক।
তাঁর জীবন ও দর্শন থেকে আমরা শিখতে পারি যে কেবলমাত্র জ্ঞানের আলোতেই অন্ধকার দূর করা সম্ভব। অতীশ দীপংকরের শিক্ষা আমাদের দেখায় কিভাবে আত্মিক উন্নতি এবং মানব কল্যাণ সম্ভব। তাই, তাঁর জীবনকথা শুধু ইতিহাস নয়, এটি আমাদের জীবনের জন্য এক অনুপ্রেরণা।