ইসকন (ISKCON) কি: ইতিহাস, দর্শন ও প্রভাব

ইসকন (ISKCON) বা ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণা কনশাসনেস একটি আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সংস্থা, যা সাধারণত হরে কৃষ্ণ আন্দোলন নামে পরিচিত। এটি বৈষ্ণব হিন্দু ধর্মের গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাখার অনুসারী। ইসকনের মূল লক্ষ্য হলো ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপাসনা এবং তার ভক্তি-বাণীকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া।

ইসকন কি? ইতিহাস দর্শন ও প্রভাব


ইসকনের প্রতিষ্ঠা

ইসকন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালের ১৩ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এ সি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ

স্বামী প্রভুপাদ ছিলেন একজন ভারতীয় আধ্যাত্মিক গুরু এবং শ্রীকৃষ্ণভক্ত। তিনি পশ্চিমা বিশ্বে বৈষ্ণব দর্শনের প্রচার করতে এবং শ্রীকৃষ্ণের ভক্তিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে ইসকন প্রতিষ্ঠা করেন।

ইসকনের মূল লক্ষ্য

ইসকনের প্রধান লক্ষ্যগুলো হলো—

  1. ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর হিসেবে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা করা।
  2. শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা এবং শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের শিক্ষা অনুযায়ী সমাজে নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা প্রতিষ্ঠা করা।
  3. বিশ্বব্যাপী শ্রীকৃষ্ণের ভক্তি আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়া এবং মানুষকে ভগবানের প্রতি ভক্তি ও প্রেমের শিক্ষা দেওয়া।
  4. সনাতন ধর্মের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং আচার-অনুষ্ঠান রক্ষা করা।

ইসকনের দর্শন

ইসকনের দর্শন গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের ওপর ভিত্তি করে। এর মূল স্তম্ভগুলো হলো:

  1. এক ঈশ্বরবাদ: শ্রীকৃষ্ণকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর বা সর্বোচ্চ বাস্তবতা হিসেবে মেনে নেওয়া।
  2. ভক্তি যোগ: ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও ভক্তি প্রদর্শন করা।
  3. নাম সংকীর্তন: ভগবানের নামগুণ কীর্তন করা। ইসকনের ভক্তরা সাধারণত "হরে কৃষ্ণ হরে রাম" মন্ত্র জপ করে থাকেন।
  4. প্রসাদ গ্রহণ: ঈশ্বরের প্রতি নিবেদন করা খাবার ভক্তি সহকারে গ্রহণ করা।
  5. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ও ভাগবত পুরাণের চর্চা: এই ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করা এবং সেগুলোর শিক্ষা অনুযায়ী জীবনযাপন করা।

ইসকনের উপাসনা পদ্ধতি

ইসকন মন্দিরে প্রতিদিন বিভিন্ন উপাসনা ও আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—

  • মঙ্গল আরতি: ভোরবেলায় ভগবানের আরতি।
  • সংকীর্তন: ভগবানের নামগুণ কীর্তন।
  • ভগবদ্‌গীতার পাঠ: প্রতিদিন শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার অংশবিশেষ পাঠ ও ব্যাখ্যা।
  • ভোগ নিবেদন: ভগবানের জন্য নিরামিষ খাবার নিবেদন।
  • প্রসাদ বিতরণ: ভগবানকে নিবেদন করা খাবার ভক্তদের মধ্যে বিতরণ।

বিশ্বজুড়ে ইসকন

ইসকনের কার্যক্রম বর্তমানে বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন দেশে ইসকনের হাজারেরও বেশি মন্দির, আশ্রম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এবং কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে।
প্রসিদ্ধ ইসকন মন্দিরগুলো হলো:

  1. মায়াপুর, ভারত: ইসকনের প্রধান কেন্দ্র।
  2. বৃন্দাবন, ভারত: শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান হিসেবে বিখ্যাত।
  3. মুম্বাই ইসকন মন্দির
  4. নিউ ইয়র্ক ইসকন মন্দির

ইসকনের সামাজিক অবদান

ইসকন শুধু আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ডেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমেও অংশগ্রহণ করে।

  1. খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি: ইসকন “ফুড ফর লাইফ” (Food for Life) প্রকল্পের মাধ্যমে বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করে।
  2. শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতা: বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রচার করে।
  3. পরিবেশ রক্ষা কর্মসূচি: ইসকন পরিবেশ রক্ষায় নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়।

ইসকন নিয়ে বিতর্ক

ইসকন অনেক প্রশংসিত হলেও, বিভিন্ন সময়ে এটি নানা বিতর্কের মুখেও পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—

  1. সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব
  2. পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার সংঘাত
  3. অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ

শেষকথা

ইসকন একটি আধ্যাত্মিক আন্দোলন, যা শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শ্রীকৃষ্ণের ভক্তি, মানবসেবা, এবং আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের মনে শান্তি এবং ভক্তির আলো জ্বালিয়েছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url